২০২২ এর শেষ সময়টিতে বিশ্ব মেতে আছে বিশ্বকাপ ফুটবলে। নভেম্বরের শেষ দশকে বিশ্ববাসী ফুটবলে মগ্ন। এবারকার আয়োজন আরব মুসলিম দেশ কাতারে। শরীরচর্চা বা জায়েয বিনোদনের জন্য কোনো নির্দোষ ক্রীড়া, ব্যায়াম বা অনুশীলন ইসলাম সমর্থন করে। এর মধ্যে জাতির প্রতিরক্ষায় কাজে লাগে, নিজের জীবন রক্ষায় কাজে লাগে, স্বাস্থ্য রক্ষায় কাজে লাগে এমন ক্রীড়াকে ইসলাম উৎসাহিতও করে। যেমন : ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাষ্ট্রীয় আইন জারি করা হয়, প্রত্যেক যুবক যেন ঘোড় সওয়ারি শিখে, যেন বর্শা নিক্ষেপ শিখে, যেন তরবারি চালানো শিখে।
নারীদের ক্ষেত্রেও নিজেদের অঙ্গনে এসব প্রশিক্ষণ আপদকালীন সময়ে গ্রহণ করা জরুরি। প্রথম মুসলিমরা যেহেতু আরব তারা কেউই সাঁতার জানতেন না। কেননা তাদের দেশে পুকুর, নদী, খাল, বিল না থাকায় তারা পানিতে নামতে অভ্যস্থ ছিলেন না। না গোসলের জন্য, না মাছ ধরার জন্য আর না অন্য কোনো কারণে। সামান্য কিছু লোক বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্থ ছিলেন বলে তাদের কেউ কেউ সাঁতার জানতেন। একবার পারস্য ভূখণ্ডের একটি দুর্গ জয় করার সময় চারপাশ ঘেরা পানিভর্তি নিরাপত্তা পরিখা পার হওয়ার সময় প্রায় পৌনে ৩০০ সাহাবীর মৃত্যু হয়।
এটি ছিল হযরত উমর রাযি. এর যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর জন্য নিবেদিতপ্রাণ জান্নাত প্রয়াসী এই আশেকের দল সাঁতার না জানা সত্ত্বেও পরিখায় নেমে মুশরিকদের এই দুর্গ জয় করার প্রত্যয় গ্রহণ করে। পানিতে নামার অভ্যাস না থাকায় এত বিপুল সংখ্যক সাহাবী শহীদ হয়ে যান। কারণ, তাদের উপর শত্রুপক্ষ গোলা নিক্ষেপ করছিল, তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করছিল। এত সাহাবীর মৃত্যুর পরেও কয়েক জন সাহাবী সেই পানিতেই সাঁতার শিখে নেন এবং রাতের শেষ অংশে যখন মুশরিক প্রহরীরা ঘুমিয়ে পড়ে তখন নিঃশব্দ সাঁতারে পরিখা পার হয়ে কয়েকজন দুর্গের আবর্জনা নিষ্কাশনের সরু নালা দিয়ে দুর্গে ঢুকে যান।
তাদের ঘুষি ও লাথিতে লোহার নেট ভেঙে পড়ে। মুশরিকরা ভেবেছিল, এ পথে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। ফজরের সময় তাঁরা দুর্গের দুয়ার খুলে দেন। শত শত সাহাবী দুর্গে ঢুকে শত্রুদের কাবু করে ফেলেন। দুর্গের প্রধান ফটকের উপর ইসলামের পতাকা উড়িয়ে ফজরের আযান ধ্বনির মাধ্যমে সাহাবীদের বিজয় ঘোষণা করে। শত্রুকে পরাজিত করে নতুন সূর্যালোকে তারা সাথীদের জানাযা পড়ে সবাইকে দুর্গের অভ্যন্তরে বাগানে দাফন করে দেন। এই সংবাদ ছিল যুগপৎ আনন্দ ও বেদনার। বিজয়ের শুকরিয়া আদায়ের সাথে সাথে আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রাযি. রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করেন, মরুদ্যানে খাল-বিল খনন করে আরব শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখাতে হবে। মদীনার পাশে তিনি কয়েকটি খাল খনন করে পানি জমা করে রাখেন।
এর ফলে সাহাবীদের নতুন প্রজন্ম ও তাবেয়ী শিশুরা সবাই সাঁতার শিখে নেন। এরপর পৃথিবীর সব যুদ্ধে ইসলামের সৈনিকদের জন্য মরুভূমি সমতল, নদ-নদী, সমুদ্রপীঠ একাকার হয়ে যায়। সে সময়কার সব যুদ্ধকৌশল তারা জানতেন। ফরমানটি ছিল এমন,
علموا أولادكم السباحة والرمي والفروسية.
এছাড়াও সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের সন্তানেরা শরীর চর্চা, ব্যয়াম দৌড়, দ্রুত হাঁটা, ভারোত্তোলন, প্রস্তর নিক্ষেপ, কুস্তি, বডি বিল্ডিং, পাহলোয়ানি ইত্যাদিতে পারঙ্গম ছিলেন। এসবকে যদি খেলা বলা হয় তাহলে ইসলামে খেলা জায়েয। শুধু জায়েযই নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিব ও অনেক সওয়াবের কাজ। শত্রুর হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য, অকল্যাণ নাশের জন্য, মানবতার শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, নিজেকে সুস্থ, দক্ষ ও সাহসীরূপে গড়ে তোলা ইসলামে অবশ্য কর্তব্য।
পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ বলেছেন,
وَ اَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّۃٍ وَّمِنْ رِّبَاطِ الْخَیْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهٖ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَ اٰخَرِیْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ ۚ لَا تَعْلَمُوْنَهُمْ ۚ اَللهُ یَعْلَمُهُمْ.
অর্থাৎ, তোমাদের শত্রুদের মোকাবেলার জন্য তোমরা সাধ্যমতো প্রস্তুতি গ্রহণ করো। আল্লাহ বিষয়টি খুলে বলেছেন, প্রশিক্ষিত ঘোড়াকে সর্বোত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে তিনি এই প্রস্ততি ও ক্রীড়াকে একটি মহান লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করেছেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহর দুশমনদের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করা, তোমাদের দুশমনদের অন্তরেও এবং এমন সব শত্রুর অন্তরে যাদের সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণা নেই।-সূরা আনফাল, ০৮ : ৬০
বিশ্বের সকল উন্নত ও সভ্য জাতি একটি শক্তিশালী সামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ রাখে। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকের আধুনিক বিশ্বের দিকে তাকালে এ বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
তবে দেশ-জাতি ও ব্যক্তির কোনো উপকার হয় না কিংবা সামান্য উপকার হলেও তার শতগুণ বেশি ক্ষতি হয় এমন কৌতুক, ক্রীড়া ও খেলা ইসলামে হারাম।
যে খেলা আল্লাহ থেকে মানুষকে গাফেল করে রাখে, আল্লাহর স্মরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আল্লাহর ফরজ হুকুম তরক করায় সে খেলা হারাম। যে খেলা অর্থের অপচয় করে, সময়ের অপচয় করে, জীবনের উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে, মানুষের মেধা-মনন ও চিন্তাশক্তিকে বিনাশ করে, তার রাজার রাজত্ব কেড়ে নেয়, ধনীর ধন কেড়ে নেয়, গরিবকে আরও গরিব করে, উৎপাদনশীল প্রজন্মকে অলস এবং বেকার বানায় সেসব খেলা হারাম। যেমন: দাবা মাকরুহে তাহরীমি। হাদীস শরীফে যাকে বলা হয়েছে শতরঞ্জ। শতরঞ্জ আরবী শব্দ। এর মূল শব্দটি হলো, চতুরঙ্গ। যেটি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনেরও কমপক্ষে ২ হাজার বছর আগে জনৈক ভারতীয় পণ্ডিতের দ্বারা তৈরি।
চীনের রাজার হুকুমে তিনি খেলাটি তৈরি করেন। রাজার হুকুম ছিল এমন একটি খেলা তৈরি করুন, যা আমার সেনাবহিনীকে খেলায় মত্ত ও ডুবন্ত রাখে, তারা যেন বিদ্রোহের চিন্তা না করতে পারে। আবার সে খেলাটিতে যুদ্ধের চারটি অঙ্গও থাকে, পদাতিক, ঘোড়সওয়ার, নৌ এবং হস্তিবাহিনী। থাকেন অধিক ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী। থাকেন রাজা স্বয়ং। তাকে চেক দেওয়াই খেলার লক্ষ্য। এতে সৈনিকদের রাজাকে আটকাবার স্বাদ খেলাতেই মিটে যায়। বাস্তবে যেন কেউ এমন চেষ্টা না করে। হাতি সোজা চলে, সেনা দমন করে, পদাতিকরা কোনা পথে গিয়ে মারে, ঘোড়া আড়াই লাফে যা পারে করে আর কিশতি বা নৌকা চলে তার নিজের পথে। মন্ত্রী চারপাশে কোপায়। আর রাজা এক পা এক পা করে সঙ্কটের পথে পা বাড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত জব্দ হয়। খেলাটি তৈরির পর তিনি চীন-রাজকে উপহার দিতে যান।
রাজা তখন খুশি হয়ে তাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং এর মেধাস্বত্ব শুধু চীনের জন্য কিনে নিতে চান। তখন পণ্ডিত বলেন, আপনি তো এর বিনিময় দিতে পারবেন না। কারণ, আমি তো বুদ্ধিজীবী। আর বুদ্ধির তো কোনো মূল্য দেওয়া যায় না। রাজার পীড়াপীড়ির পর পণ্ডিত বলেন, আমার এ চতুরঙ্গের পাটিতে ৩২টি ঘর আছে। আপনি যাই দিতে চান ৩২ বার দ্বিগুণ করে তারপরে দিন। রাজা হিসাব করে দেখেন, যাই দেওয়া হোক ৩২ বার দ্বিগুণ করে দিলে তাঁর রাজত্বই ফুরিয়ে যায়। তখন পণ্ডিত এটি রাজাকে বিনে পয়সায় দান করে আসেন। এরপর তাকে পারস্য সম্রাট ডেকে নেন এবং তার কাছে এই খেলাটি ভিক্ষা চান। বলেন, আমি শুনেছি, চৈনিক সম্রাট আপনাকে অর্থ-সম্পদ দিতে চেয়ে আপনার জ্ঞানের অপমান করেছেন।
আমি আপনার কাছে এ খেলাটি ভিক্ষা চাই। কারণ, আপনার খেলার সবগুলি ঘর ভরে দ্বিগুণ করে দেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর কারও নেই। সে চেষ্টাও আমি করব না। তখন সেই বাঙালি পণ্ডিত তার চতুরঙ্গ খেলার বোর্ড এবং গুটিসহ একটি বাক্স পারস্য সম্রাটের হাতেও তুলে দেন এবং বলেন, এই খেলাটির নাম চতুরঙ্গ। আপনার সাম্রাজ্যে যেন এ নামেই এটি চালু থাকে। একসময় এ খেলা আরব দেশে প্রবেশ করে। বাংলা ও ফার্সি চতুরঙ্গ পরিণত হয়ে শতরঞ্জে। আরবী উচ্চারণে এমনই হওয়ার কথা। মানুষের সময় ও মেধা বিনাশে এই শতরঞ্জের কোনো তুলনা হয় না। আরবরা একে এত বেশি অবলম্বন করে যে বসে খেলার জন্য ইরানিরা ছোট দড়ির কার্পেট বানিয়ে এর নাম রাখে শতরঞ্জি। বাংলায় নাম পড়ে দাবা। ইংরেজিতে চেস্ট। এমন নামকরণের ইতিহাস আমার জানা নেই।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দুনিয়ায় এসে দেখলেন আরব ও পারস্যে মানুষ শুধু দাবা খেলে তখন তিনি এই খেলা খেলতে বারণ করেন। কারণ, অর্থহীন খেলা আর অযথা সময় পার করার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। তিনি দেখলেন, নারী ও শিশুরা লুডু জাতীয় খেলা খেলে বিস্তর সময় ব্যয় করে। তিনি তখন বললেন,
مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدشِيرِ فَكَأَنَّمَا صَبَغَ يَده فِي لَحْم خِنْزِير وَدَمه.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইবাদত ভুলে, যিকির ভুলে, নিজের দায়িত্ব ভুলে কেবল মাতালের মতো সময় পার করার জন্য লুডু, গুটি বা দাবা খেলবে সে যেন শূকরের মাংস ও রক্ত দিয়ে তার হাত রাঙাল।-সহীহ মুসলিম, হদীস 2260
জীবনধর্মী দীন মহান ইসলাম মানুষকে বাস্তববাদী ও কর্মচঞ্চল রাখার জন্য যেসব বেহুদা খেলা থেকে কঠোর সতর্কতার সাথে ফেরাতে চেয়েছে তার চেয়ে আরও হাজার গুণ বেহুদা হচ্ছে ক্রিকেট ও ফুটবল বিশ্বকাপ, যার প্রকোপে সারা দুনিয়ার মানুষ এখন মাতালের মতো কাঁপে। উন্মাদ হয়ে যায়। আত্মহত্যা করে। হার্ট অ্যাটাক করে। শত্রুতা ও খুনাখুনি করে। ঘর-সংসার ও সমাজ ভেঙে যায়। গরিব মানুষের প্রতি নজর না দিয়ে এই ক্রিকেট ও ফুটবল জুয়ার পেছনে মানুষ নিজের অর্থকড়ি ঢেলে দেয়।
অনেক আত্মমর্যাদাহীন অসভ্য জাতি নিজের দেশকে ভিনদেশিদের পতাকায় ঢেকে ফেলে। এসব আসরকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে চালু হয় জুয়া, যিনা- ব্যাভিচার, গাফলত, অপচয় এবং মদ ও মাদকের ছড়াছড়ি। যে খেলাকে কেন্দ্র করে এত পাপের জন্ম হয় তা কীভাবে জায়েয হতে পারে? অবশ্য ক্ষতি, খারাবি, গাফলত, জুয়া ও গোনাহ না করার শর্তে শরীরচর্চা পর্যায়ে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার অবকাশ আছে। বাংলাদেশে প্রচলিত হাডুডু, কুস্তি, বলি খেলা, গোল্লাছুট, দৌড়, বর্শা নিক্ষেপ, রাইফেল শুটিং, আরচারি, দড়ি লাফ, সাঁতার, পাঞ্জা লড়া, ভারোত্তোলন, লং জাম্প, হাই জাম্প, হর্স স্টেপ জাম্প ইত্যাদি শরীরচর্চা পর্যায়ের খেলাও শর্তসাপেক্ষে জায়েয।
আমি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। বহু বছর আগে কোনো এক বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়েও আমি একটি পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। আজ আমি শুরু করা বিষয়বস্তু বা শিরোনামের উপর আর একটি কথাও লিখব না। কারণ আমি আর কিছু বলা বা লেখার প্রয়োজন অনুভব করি না। আমার কাছে বিশ্বকাপের ব্যাপারে বলার জন্য মহান পয়গম্বরে ইসলাম হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বলা শতরঞ্জ ও নরদশীরের চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। অতএব বুঝহ সুজন, যে জানো সন্ধান।
লেখক, গবেষক, কলামিস্ট, আন্তর্জাতিক স্কলার ও সহ-সম্পাদক দৈনিক ইনকিলাব